ইসমাইল খান টিটু:
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা ও ধনাগোদা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ৬৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের আওতায় মেঘনা ও ধনাগোদা নদীর ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এবং মেঘনার নদীর পশ্চিম পার্শ্বে ৫ কিলোমিটার জায়গায় তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি একসময় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে জানা যায়, এ অঞ্চলের মেঘনা ও ধনাগোধা নদীর পাড় ঘেঁষে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও প্রবল স্রোতে মেঘনা নদীর জহিরাবাদ লঞ্চ ঘাট থেকে সোনারপাড়া-সানকিভাঙ্গা, চরমাছুয়া-জনতার বাজার এবং ধনাগোদা নদীর ষাটনল থেকে কালীপুর, নবীপুর-হাফানিয়া-খাগুরিয়া, ঠেটালিয়া-সিপাইকান্দি পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ের চরাঞ্চল এলাকার বোরচর, চরউমেদ, নাছিরারচরে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
এই ভাঙ্গনের ফলে হুমকির মুখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, কয়েক হাজার একর ফসলি জমি, কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট বাজার, হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্রাসা, বসতবাড়ীসহ গুরুত্বপূর্ন বিভিন্ন স্থাপনা। পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে মানুষ। হঠাৎ করে ধনাগোদা নদী ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীভাঙন ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তা না হলে আরও শত শত বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধ এলাকার সোনারপাড়া এলাকার নদী ভাঙ্গনের দৃশ্য।
জানা গেছে, ১৯৮৬-৮৭ সালে সেচ প্রকল্পের ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই মূল বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের পর থেকে এ পর্যন্ত দুবার এই বাঁধটি ভেঙে যায়। তখন কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয় অঞ্চলের মানুষে। পরবর্তীতে পুনরায় মেরামত করা হয় এই বেড়িবাঁধটি।
স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভাঙ্গন কবলিত অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবৎ ড্রেজার দিয়ে দিনে রাতে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন হয়েছিল। যার প্রভাবে এখন নদীর এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছ।
কালিপুর বাজার সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মো. ফারুক হোসেন জানায়, এই এলাকায় নদীর আচমকা ভাঙ্গনের ফলে বাজারের ব্যবসায়ী, স্থানীয় বসতী, কালিপুর স্কুল এন্ড কলেজ, কালিপুর সপ্রাবি, কালিপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ফয়েহ আহম্মেদ মেমোরিয়াল হাসপাতাল এই অঞ্চলের মানুষরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। হঠাৎ করেই এত তীব্র ভাঙ্গন হবে যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।

ধনাগোদা নদীর কালীপুর বাজারে হঠাৎ করে ভেঙে যাচ্ছে ; আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এখানের মানুষ।
সোনারপাড়া এলাকার মো. মনির হোসেন খান জানান, দীর্ঘদিন মেঘনা নদীর জহিরাবাদ লঞ্চ ঘাট থেকে উত্তরদিকে প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আবার নতুন করে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এখানে অনেক মানুষের ঘরবাড়ি ইতিমধ্যে নদীগর্ভ বিলীন হয়ে গিয়েছে।
ভাঙ্গন কবলিত সিপাইকান্দি এলাকার ইউপি সদস্য একেএম গোলাম নবী খোকন জানান, সিপাইকান্দি ঠেটালিয়া অঞ্চলে ধনাগোদা নদীর দেড় কিলোমিটার ভাঙ্গন এলাকায় ইতিমধ্যেই পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙ্গন রোধে ব্লক নির্মাণ, জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা শুরু করেছে।
ভাঙ্গনকবলিত এলাকা ষাটনল ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদাউস আলম সরকার জানায়, এই ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলনের কারনে ষাটনল ইউনিয়নের ষাটনল, কালিপুর সহ কয়েকটি অঞ্চল ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। তাই অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ সহ পাশ্ববর্তী এলাকায় বালি মহলের নামে ইজারা দেয়া যা মতলবের জন্য খুবই হুমকির ও আতংকের।
কথা হলে খাগুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মিয়া মঞ্জুর আমীন স্বপন জানায়, ধনাগোদা নদীর ভাঙ্গনে খাগুরিয়া, হাপানিয়া ও নবীপুর এলাকার অনেক পরিবার ইতিমধ্যে জমি হারিয়ে পথে বসেছে। কখন যে নদী ভেঙে আমাদের ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ, হাট বাজার, ফসলী জমিসহ নদীতে বিলীন হয়ে যায় এনিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। এমনকি মেঘনা ধনাগাদা বেড়ী বাঁধটিও ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে মেঘনা ধনাগোদা পানি ব্যবহারকারী ফেডারেশনের সভাপতি রাসেল ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী শহীন জানান, এই মেঘনা ও ধনাগোদা নদীদে অবৈধ বালি উত্তোলনের কারনে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ সেচ প্রকল্প আজ হুমকির মুখে। মেঘনা ও ধনাগোদা সেচ প্রকল্প ঘেষা ধনাগোদা নদীর তীরবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে বাড়ী ঘর ও ফসলী জমি।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের (পাউবো’র) নির্বাহী প্রকৌশলীর মো. সেলিম শাহেদ বলেন, মেঘনা ও ধনাগোদা নদীর ভাঙ্গন কবলিত এলাকা আমরা পরিদর্শন করেছি। কয়েকটি অঞ্চলে ভাঙ্গন দেখা দিলে আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই। তবে নদীর তীর ও সেচ প্রকল্প বাঁধ রক্ষায় ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধের বিষয়ে আমরা সহসাই লিখিত অভিযোগ জানাবো।
এ বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা কুলসুম মনি বলেন, নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি জেলা প্রশাসকে জানিয়েছি। মেঘনা ও ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালি কাটার বিরুদ্ধে আমরা অভিযান করছি। মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প ও এর তীর রক্ষায় এই নদীতে অবৈধ বালি কাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অভ্যহত থাকবে।

মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধ এলাকার চরমাছুয়া এলাকার নদী ভাঙ্গনের দৃশ্য।