২০২২ সালের ৩০ জুন, রাত সাড়ে ১০টা। সন্তানদের নিয়ে গ্রামীণ টেলিকম ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও তার স্ত্রী রাতের খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যখন তাদের নজরে আসে, দেড় বছরের বাচ্চাটার জন্য বাসায় দুধ নেই। খাওয়ার আগে বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে বাসার পাশেই মিরপুরের ইসিবি চত্বরে একটি দোকানে যান ফিরোজ।

বাড়ি ফেরার পথে মুখোশধারী ১০-১৫ জন তাকে থামিয়ে পরিচয় জানতে চায়। তারা ফিরোজের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং তাকে তুলে নিয়ে যায়।

এর কয়েক ঘণ্টা পর ফিরোজকে নেওয়া হয় একটি বন্দীশালায়। ফিরোজ জানতেন না যে এটাই সেই ‘আয়নাঘর’।আয়নাঘরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় ফিরোজের ওপর। সেইসঙ্গে তাদের নির্দেশ না মানলে ফিরোজের পরিবারের সবাইকে তুলে নিয়ে আসারও হুমকি দেওয়া হয়।

তারা ফিরোজের একটি জবানবন্দি রেকর্ড করতে চেয়েছিল, যেখানে তিনি বলবেন যে মামলা তুলে নিতে শ্রমিকদের রাজি করানোর জন্য ইউনিয়ন নেতারা গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল।

আয়নাঘরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ফিরোজ বলেন, বাচ্চার জন্য কেনা দুধটাও বাসায় দিতে দেয়নি ওরা। দ্রুত চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় আমাকে। এতদিন মুখ খোলার সাহস পাইনি ভয়ে। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর সেই অন্ধকার সময়ের কথাগুলো সবাইকে বলার সাহস পাচ্ছি।

কয়েক বছরের আইনি লড়াইয়ের পর দাবি আদায় হওয়ায় শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ১১০টি মামলা ২০২২ সালের ২৩ মে তুলে নেন ইউনিয়ন নেতা ও কর্মচারীরা। এর প্রায় এক মাস পর ২০২২ সালের ৩০ জুন ফিরোজ মাহমুদকে সাদাপোশাকধারী লোকজন তুলে নিয়ে যায়। তাকে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।

আয়নাঘরে সাত দিন নির্যাতনের পর ৬ জুলাই ভোররাতে ফিরোজকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে তিনি দেখা পান তার সহকর্মী ও ইউনিয়ন সভাপতি কামরুজ্জামানের। কামরুজ্জামানও ফিরোজের মতোই আটক ছিলেন এবং একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন।

এরপর তাদের দুজনকে জালিয়াতি ও আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে নিয়ে ফিরোজ ও কামরুজ্জামানকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হিসেবে একটি স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়। ফিরোজ বলেন, সেই স্ক্রিপ্টের একটি অনুলিপি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল। সেটাকেই আমার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হিসেবে রেকর্ড করেছে।

এরপর তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে প্রতিবারই তা নাকচ করে দিয়েছেন আদালত। ৯ মাস জেলে থাকার পর অবশেষে ২০২৩ সালের এপ্রিলে জামিন পান ফিরোজ।

সূত্র: ডেইলি স্টার